নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ কোচিং নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ২০১৬ এর ‘অতিরিক্ত ক্লাস’কে কেন্দ্র করে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের চন্দ্রদীপ হাইস্কুল এন্ড কলেজে চলছে শিক্ষকদের বাণিজ্য। নীতিমালার সুযোগ নিয়ে অর্থ রোজগারের কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থীদের এক প্রকার বাধ্য করেই অতিরিক্ত ক্লাস নিচ্ছেন তারা। অভিভাবকদের অভিযোগ, কোচিং বন্ধ করায় শিক্ষকরা অতিরিক্ত ক্লাসের পাঠদানের চেয়ে অর্থ রোজগারকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কোচিং নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা (সংশোধিত ২০১৬) অনুসারে কোচিং বন্ধের নির্দেশনার পাশাপাশি নিজ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাসের বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্লাসে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস করতে পারবে। বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া যাবে। কিন্তু বিধিমালার তোয়াক্কা না করেই চন্দ্রদীপ হাইস্কুল এন্ড কলেজে এক প্রকার কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। নিয়মানুসারে অভিভাবকদের অনুমতি বা রসিদের মাধ্যমে টাকা আদায় অথবা ফান্ড তৈরি করে টাকা নির্দিষ্ট ফান্ডে জমা ও বণ্টন কোনোটাই করা হয় না। বরং প্রায় সব শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত ক্লাসে বাধ্য করা হয়। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এভাবে কোচিংয়ে বাধ্য করার বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করেছেন অভিভাবকদের অনেকেই।
একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে অভিযোগ পাওয়ার পরে মাঠে নামে অনুসন্ধান টিম। সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, রমজানের শুরু থেকেই ওই বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং বানিজ্য শুরু করেন শিক্ষকবৃন্দ। একাধিক অভিভাবক জানায়, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বলেন অবশ্যই বাধ্যতামুলক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাস করতে হবে। যদি কেউ বাইরে কোচিং করে তবে ওই শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে। পর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিকৃয়া সৃষ্টি হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বাধ্যতামুলক বিদ্যালয়ে কোচিং করতে হয় এবং ফি পরিশোধ করতে হয়। আর্থিক অনটনের কারণে কারো অপরাগতা প্রকাশের সুযোগ নেই। কেউ কোচিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে তাকে ফেল করানো, নম্বর কম দেয়া এমনকি টিসি দিয়ে বের করে দেয়ার হুমকী দেয়া হয়। এছাড়াও অভিভাবকদের কাছে কোচিংয়ে পাঠানোর জন্য তাড়া দিয়ে মুঠোফোনে কল করেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। ফলে বাধ্য হয়েই আমাদের বিদ্যালয়ে কোচিং করতে হয়। ওই বিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজন অভিভাবক বলেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের জিম্মি করে অর্থ অতিরিক্ত ক্লাসের নামে অর্থ আদায় করছে। আমাদের কষ্টার্জিত টাকা দিতে বাধ্য হতে হয়।
কোচিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে চন্দ্রদীপ হাইস্কুল এন্ড কলেজে অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বলেন, নিয়মানুসারে আমরা অতিরিক্ত ক্লাসের ফি আদায় করে থাকি। তবে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা বা রেজাল্ট পরিবর্তনের বিষটি তিনি অস্বীকার করেন। ২৬মে শনিবার সকালে বিদ্যালয়ে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় বন্ধের দিনেও শিক্ষর্থীরা বিদ্যালয়ের ড্রেস পড়ে ক্লাস করছেন এব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বেপারী তেলেবেগুনে ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে গেছেন আমার অনুমতি নিছেন আগে? আমার অনুমতি না দিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে কেন গেছেন? উত্তেজিত হয়ে এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বলেন, আপনাদের যত খুশি লেখেন দেখি আপনি কি করতে পারেন, আমারও উপর মহলে লোক আছে, আমি দেখতে চাই লিখে আপনি কি করতে পারেন, ওসব লিখলে আমার কিছু যায় আশে না।’
এব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নিয়মের বাইরে এক চুল যাওয়ার কোনো সুযোগ কারই নেই। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো খুব শিগ্রই, শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা বা চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায়ের প্রমাণ মেলে তবে বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে বিদ্যালয়টির কোচিং বানিজ্য নিয়ে অনুসন্ধানে অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বেপারীর বিরুদ্ধে বেড়িয়ে আসে আরো নানা তথ্য। অর্থলোভী এই অধ্যক্ষ এর পূর্বে বেশ কয়েকবার ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ পুরো এলাকাজুড়ে হয়েছেন ব্যাপক সমালোচিত, হয়েছেন বরখাস্তও। সূত্র জানায়, ২০১৬সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বাদশ শ্রেণির প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষার জন্য ৩ হাজার ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করেন অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বেপারী। হতদরিদ্র দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নয়ন শীল ধারদেনা করে ২ হাজার ৩০০ টাকা পরিশোধ করলেও অবশিষ্ট ৭৫০ টাকার জন্য অর্থলোভী অধ্যক্ষ তাকে মারপিট করে। এতেও ক্ষান্ত হননি নয়নকে টেনেহিচঁড়ে সবার সামনেই গলাধাক্কা দিয়ে লাথ্থি মেরে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেন অধ্যক্ষ। এ ঘটনায় লজ্জা ও অভিমানে বাড়িতে গিয়ে আমগাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় নয়ন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় নয়নকে উদ্ধার করে শেরেবাংলা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় পুরো বাবুগঞ্জ জুড়ে সৃষ্টি হয় সমালোচনার ঝড়। অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেন। কলেজ গেটের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা একই দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তখন পলাতক ছিলেন প্রণব কুমার বেপারী। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে জরুরি বৈঠক ডেকে অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বেপারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে পরে সবকিছু ম্যানেজ করে আবারও তার পদে ফিরে আসেন ধুরন্ধার প্রণব কুমার বেপারী। তৎকালীন সময়ে মাধবপাশা ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন হাওলাদার সাংবাদিকদের জানান, অধ্যক্ষ প্রণব কুমার বেপারী এর আগেও বকেয়া টাকা আদায়সহ নানা কারণে একাধিকবার ছাত্রকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন।
প্রিয় পাঠক সুচতুর প্রণব কুমার বেপারীর ফিরিস্তি জানতে চোখ রাখুন দ্বিতীয় পর্বে. . . . .
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply